মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
পটুয়াখালীতে মাদ্রাসা থেকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে কিশোরকে অপহরণ। ইজতেমা ময়দানে নিহতের ঘটনায় জামায়াত আমিরের শোক জেলা জজের ড্রাইভার পরিচয়ে অবৈধভাবে জমি দখলের চেষ্টার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন পটুয়াখালীতে হত্যার উদ্দেশ্য সাংবাদিককে বেধরক মারধর থানায় মামলা। কসম পাচার কালে মূল হোতা আটক গলাচিপায় চেতনানাশক দ্রব্য ব্যবহার করায় মা-ছেলে অসুস্থ  গলাচিপায় পাচারের সময় ১৭ কচ্ছপসহ ব্যবসায়ী আটক লালমনিরহাটে আ.লীগ নেতা সুমন খান ও স্ত্রীর ব্যাংকে ২৩৭ কোটি টাকা, অর্থপাচার মামলা গলাচিপায় পুলিশের মধ্যস্থতায় আড়ৎদারের টাকা ফেরত দিয়েছেন ফল ব্যবসায়ী গলাচিপায় জেলেদের মাঝে চাল বিতরন

নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা : অনন্ত প্রেরণা

অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেটের সময় : বুধবার, ২৫ মে, ২০২২
  • ৩৫৩ সময় দর্শন

বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘বিদ্রোহী এতটাই বিখ্যাত হয়েছে যে কাজী সব্যসাচীর কণ্ঠে সেটির রেকর্ড বিপুল বিক্রি হয়। ইউটিউবে দেখছিলাম, তাঁর ওই আবৃত্তি লাখ লাখ বার শোনা হয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ‘বিদ্রোহী কবিতা’র ১০০ বছর পূর্ণ হয়েছে। নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতাসমূহের একটি এই ‘বিদ্রোহী’।

এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ধূমকেতুতে (২২ আগস্ট ১৯২২) ছাপা হয়। প্রকাশিত হওয়া মাত্রই এটি ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি ‘চির উন্নত শির’ বিরাজমান। কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭০তম জন্মদিনে শংসাপত্রে লিখেছিলেন, ‘তোমার দিকে তাকিয়ে আমাদের বিস্ময়ের কোনো সীমা নেই’। রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, ‘দেখ উন্মাদ তোর জীবনে শেলীর মত, কীটসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে-তুই প্রস্তুত হ। ’

শুধু বিতর্ক-অভিনন্দনই নয়, বিদ্রোহী কবিতা তখন বাংলার যুবমানসকে অনুপ্রাণিত করেছিল, বিপ্লবীদের কণ্ঠে দিয়েছিল বৈপ্লবিক ভাষা, সমাজের বিভিন্ন স্তরে জাগ্রত করেছিল চেতনা। কবিতাটিতে কবির আত্মজাগরণ বিভিন্নরূপে, বিচিত্রভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছিল। তাই এক কথায় বলা যায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা অনন্ত কাল ধরে আমাদের প্রেরণা যোগাবে।

নজরুল তার লেখায় যেমনটি বলেছেন-জীবনের সেই ট্র্যাজেডি দেখার জন্য কতদিন অকারণে অন্যের জীবনকে অশ্রুর বর্ষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু আমার জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মতো তপ্ত। আমার বেশ মনে পড়ছে একদিনের আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা- আমার ছেলে মারা গেছে, আমার মন যখন তীব্র পুত্রশোকে ভেঙে পড়েছে ঠিক সেই দিন সেই সময়ে আমার বাড়িতে হাসনাহেনা ফুটেছে। আমি প্রাণ ভরে সেই হাসনাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম।

আমার কাব্য, আমার গান, আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে। যদি কোনোদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শূন্য থেকে অসময়ে নামতে হয়, তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল; সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পূর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আমাদের মাঝে কেঁদে গেল।

যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনে, আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি-আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।

যেদিন আমি চলে যাব সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়তো আমার নামে, দেশপ্রেমিক-ত্যাগীবীর-বিদ্রোহী বিশেষণের পর বিশেষণ, টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পড় মেরে, বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে-বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোনো একটি কথা স্মরণ করো, তোমার ঘরের আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটা ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি-

“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু
আর আমি জাগিবনা
কোলাহল করি সারা দিনমান
কারো ধ্যান ভাঙ্গিবনা
নিশ্চুল-নিশ্চুপ আপনার মনে
পুড়িব একাকী
গন্ধ বিধুর ধূপ”।

দুই.
সেই যুগে একটা ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছিল যেটা হলো দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সমাজ বিপ্লবকে মেলানো। স্বদেশী আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিলেন তারা সমাজ বিপ্লবের কথা ভাবতেন না। কিন্তু এই বিপ্লব ছিল নজরুলের রক্তে, ‘বলেছেন অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়। তাঁর মূল্যায়নে যারা সবকিছু ভেঙে নতুন করে গড়তে চাইছে তাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল নজরুল ইসলামের জ্বালাময়ী কবিতা- বিদ্রোহী। ’

সবকিছু ভেঙে নতুন করে গড়ার চেতনা প্রকাশ পেয়েছিল এই রচনায়। সেই কবিতা রাতারাতি তাঁকে একেবারে কেন্দ্রে বসিয়ে দিয়েছিল। তার পরবর্তী আট-দশ বছর ধরে তিনি যে সাম্যের গান গাইলেন নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বললেন, কৃষক মজুরের দুঃখের কথা বললেন, কৃষক শ্রমিক পার্টির হয়ে কাজ করলেন-এ সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়ে তাঁর যে মন প্রকাশ পেল তা ছিল একেবারে আলাদা। এর মধ্যে কোনো আভিজাত্য নেই। এবারে নিচ থেকে ওঠা মানুষের গান। তাদের কথা। যারা দলিত, যারা অত্যাচারিত যাদের ভাষা ছিল না, নজরুলের কলমে তারা ভাষা খুঁজে পেল। ”

নজরুলের হাত দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সর্বকালের এক শ্রেষ্ঠ কবিতা। ‘বিদ্রোহী’ নামের এই কবিতা মোট ১৪৭ পঙক্তির। এ কবিতায় নজরুল অনেক রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন ভাব-ভাষা ছন্দ-চিত্রকল্পের কারুকার্যে। অনন্য অসাধারণ এক মহা কবিতা, একটানা লেখা। খুব থেমে ভেবে চিন্তে লেখা হয়নি। পাছে ভাবনা ভাষাকে ওভারল্যাপ করে যায় প্রচণ্ড গতিশীলতার কারণে, সেজন্যই বোধহয় কালির কলমও ব্যবহার করেননি। উড পেন্সিলের খুব তাড়াতাড়ি অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে তোলা যায়। এই গতিময়তার জন্যই নজরুলের অনেক রচনাই উড-পেন্সিলে লেখা। বিদ্রোহীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তখন উট-পেনের চল হয়নি। খুব তদগত বিশ্লেষণেই বোঝা যায়, এ কবিতা শুধু বিষয়বস্তুতেই নয়, শৈল্পিক গুণেও বাংলা আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক মাত্রা পেয়ে গেছে। অভূতপূর্ব কাব্যরস সৃষ্টির বিশিষ্টতায় চিহ্নিত। নজরুলের কবি-কল্পনা এখানে বিচিত্র রঙে সম্প্রসারিত। ভাষাগত কাব্যময়তা বিচিত্র বর্ণে রঙিন। বিদ্রোহী পড়ে বিনয়কুমার সরকার তাঁর ‘ফিউচারিজ্ম অব ইয়ং এশিয়া’ নামের ইংরেজি গ্রন্থে ১৯২২ সালেই লেখেন: “বিদ্রোহী দেখবা মাত্র নজরুলের ভেতরে আমি হুইটম্যান আর রবীন্দ্রনাথ দুজকে একসঙ্গেই পাকড়াও করেছিলাম। তবুও বুঝে নিলাম লেখক বাপ্কা বেটা বটে! বিংশ শতাব্দীর প্রথম কুরুক্ষেত্রের পরবর্তী অন্যতম যুগ-প্রবর্তক বাঙালির বাচ্চা নজরুল। ”

বিনয় সরকার বিদ্রোহী কবিতার তর্জমা করেন জার্মান ও ইংরেজি ভাষায়। রুশ ভাষায় বিদ্রোহী অনূদিত হয়েছে আরও পরে ষাটের মাঝামাঝি। চীনা ভাষায় নজরুলের যে বাছাই কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে কয়েক বছর আগে তাতেও বিদ্রোহী কবিতা আছে প্রথম দিকেই। ‘ বিদ্রোহী কবিতা সম্পর্কে তখনকার আনন্দবাজার পত্রিকা যে অভিমত প্রকাশ করে তাও উল্লেখযোগ্য। আনন্দবাজার যা লিখেছিল তার মর্মার্থ হলো এই একটা কবিতা লেখার পর নজরুল যদি আর কোনো কবিতা না-ও লেখেন তাতেও কিছু এসে যায় না। এক ‘বিদ্রোহী’ কবিতাখানাই তার কাব্য প্রতিভার বিশাল পরিচয় বহন করে। ‘ বিজলী ও মোসলেম ভারতে ছাপার পর বিদ্রোহী পুনর্মুদ্রিত হয় মাঘ, ১৩২৮ সংখ্যার প্রবাসীতে, বৈশাখ ১৩২৯-এর সাধনা পত্রিকায়। পরে ধূমকেতু ও দৈনিক বসুমতীতেও।

অন্য পত্রিকা থেকে ভালো লেখা পুনমুর্দ্রণ হতেই পারে এটা ঠিক। কিন্তু বিদ্রোহীর বেলায় যা হয় তার তুলনা বিরল। শুধু তাই নয়, ‘বিদ্রোহী’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখে খান মঈনুদ্দীন ১৯২৩ সালে ছয় মাসের জন্য জেলেও গিয়েছেন। এ ঘটনাও সচরাচর ঘটে না। “বিদ্রোহী’র –জয়-তিলক আমার ললাটে অক্ষয় হয়ে গেল আমার তরুণ বন্ধুদের ভালোবাসায়। একে অনেকেই কলঙ্ক-তিলক বলে ভুল করেছে, কিন্তু আমি করিনি। বেদনা সুন্দরের গান গেয়েছি বলেই কি আমি সত্য সুন্দরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি?

আমি বিদ্রোহ করেছি-বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে-যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন-পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। হয়তো আমি সব কথা মোলায়েম করে বলতে পারিনি, তলোয়ার লুকিয়ে তার রুপার খাপের ঝকঝকানিটাকেই দেখাইনি-এই তো আমার অপরাধ। এরই জন্য তো আমি কুসংস্কারের বিধি-নিষেধের বেড়া অকুতোভয়ে ডিঙিয়ে গেছি, এর দরকার ছিল মনে করেই। …”

“আমিও মানি, গড়ে তুলতে হলে একটা শৃঙ্খলার দরকার। কিন্তু ভাঙার কোনো শৃঙ্খলা বা সাবধানতার প্রয়োজন আছে মনে করিনে। নতুন করে গড়তে চাই বলে তো ভাঙি- শুধু ভাঙার জন্যই ভাঙার গান আমার নয়। আর ওই নতুন করে গড়ার আশায়ই তো যত শীঘ্র পারি ভাঙি- আঘাতের পর নির্মম আঘাত হেনে পচা-পুরাতনকে পাতিত করি। আমিও জানি, তৈমুর, নাদির সংস্কার প্রয়াসী হয়ে ভাঙতে আসেনি, ওদের কাছে নতুন-পুরাতনের ভেদ ছিল না। ওরা ভেঙেছিল সেরেফ ভাঙার জন্যই। কিন্তু বাবর ভেঙেছিল দিল্লি আগ্রা-ময়ূরাসন-তাজমহল গড়ে তোলার জন্য। আমার বিদ্রোহও ‘যখন চাহে এ মন যার’ বিদ্রোহ নয়, ও আনন্দের অভিব্যক্তি সর্ববন্ধন মুক্তের-পূর্ণতম স্রষ্টার। ”

আসলে বিদ্রোহী কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। সব হিসাব খতিয়ে এবং সমসাময়িক ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে বেরিয়ে আসছে যে এটাই ছিল কবিতাটির রচনার সময়। শুধু একটি ঘটনাকে আমি নজরে রেখেছিলেম বলেই আমার এই ভুলটা হয়েছিল। “বিদ্রোহী কবিতা প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘বিজলী’ নামক সাপ্তাহিক কাগজে। সেই সময়ে বৃষ্টি হয়েছিল। এই বৃষ্টিটাই আমার স্মৃতিতে আটকে ছিল। আমাদের ৩/৪-সি, তালতলা লেনের বাড়িটি ছিল চারখানা ঘরের একটি পুরো দোতালা বাড়ি। তার দোতলায় দু’খানা ঘর ও নিচের তলায় দু’খানা ঘর ছিল। পুরো বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন ত্রিপুরা জিলার পশ্চিমগাঁও নওয়াব ফয়জুন্নিসা চৌধুরানীর নাতিরা (দৌহিত্ররা) তাঁরা নিচের দু’খানা ঘর আমাদের ভাড়া দিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে নিচেরও একখানা ঘরের তাঁদের দরকার হয়। তখন নজরুল আর আমি নিচের তলার পুব দিকের অর্থাৎ বাড়ির নিচেকার দক্ষিণ পূর্ব কোণের ঘরটি নিয়ে থাকি।

এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার “বিদ্রোহী” কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত ১০টার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে বসেছি এমন সময়ে নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। “বিদ্রোহী” কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে আমি কী যে বলব তা জানিনে। কোনো দিন কোনো বিষয়ে আমি উচ্ছ্বসিত হতে পারি না। যে লোক প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য তার সামনা সামনি তাকে প্রশংসা করাও আমাকে দিয়ে হয়ে ওঠে না। অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ লিখেছিলেন, ‘আমার মনে হয় নজরুল ইসলাম শেষ রাত্রে ঘুম থেকে উঠে কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না। তার ঘুম সাধারণত দেরিতেই ভাঙত, আমার মতো তাড়াতাড়ি তার ঘুম ভাঙত না। ’

এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন্ ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তার হাত তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল। …সামান্য কিছু বেলা হতে ‘মোস্লেম ভারতের’ আফ্জালুল হক সাহেব আমাদের বাড়িতে এলেন। নজরুল তাঁকেও কবিতাটি পড়ে শোনালেন। তিনি তা শুনে খুব হইচই শুরু করে দিলেন, আর বললেন, “এখনই কপি ক’রে দিন কবিতাটি, আমি সঙ্গে নিয়ে যাব। ” পরম ধৈর্যের সহিত কবিতাটি কপি ক’রে নজরুল তা আফ্জাল সাহেবকে দিল। তিনি এই কপিটি নিয়ে চলে গেলেন। আফ্জালুল হক সাহেব চ’লে যাওয়ার পরে আমিও বাইরে চলে যাই। তার পরে বাড়িতে ফিরে আসি ১২টার কিছু আগে। আসা মাত্রই নজরুল আমায় জানাল যে, “অবিনাশদা (বারীন ঘোষেদের বোমার সহবন্দি শ্রীঅবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য) এসেছিলেন। তিনি কবিতাটি শুনে বললেন, “তুমি পাগল হয়েছ নজরুল, আফ্জালের কাগজ কখন বা’র হবে তার স্থিরতা নেই, কপি ক’রে দাও “বিজলীতে ছেপে দিই আগে। ” তাঁকেও নজরুল সেই পেন্সিলের লেখা হতেই কবিতাটি কপি করে দিয়েছিল। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি (মুতাবিক ২২ পৌষ, ১৩২৮ বঙ্গাব্দ) তারিখে, শুক্রবারে “বিদ্রোহী” ‘বিজলীতেই প্রথম ছাপা হয়েছিল। বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও কাগজের চাহিদা এত বেশি হয়েছিল যে শুনেছিলেম সেই সপ্তাহের কাগজ দু’বার ছাপা হয়েছিল। অনেকে যে লিখেছেন “বিদ্রোহী” ‘মোসলেম ভারতে’ প্রথম ছাপা হয়েছিল সেটা ভুল। ”

“বিদ্রোহী” ছাপা হওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎকারের কথাও শ্রীঅবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন এবং নজরুলের মুখে শুনেই লিখেছেন। তাতে আছে, কবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনানোর পরে তিনি নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন। নজরুল আমাকে এই খবর দেয়নি। তবে, আমাকে কথাটা না বলার কারণ হয়তো এই ছিল যে, আমি তার কবিতার প্রথম শ্রোতা হয়েও কোনো আনন্দ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিনি। অবিনাশবাবু লিখেছেন, ঠাকুর বাড়িতে গিয়ে নজরুল নিচে থেকেই “গুরুজী গুরুজী” বলে চেঁচিয়েছিল। অবিনাশবাবু হয়তো ভুল বুঝেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথকে কেউ “গুরুজী” ডাকতেন না, ডাকতেন “গুরুদেব”। মোহিতলাল প্রচার করছিলেন যে নজরুল ইসলাম তাঁর “আমি” শীর্ষক একটি লেখার ভাব নিয়ে কবিতাটি লিখেছে অথচ কোনো ঋণ স্বীকার করেনি। এই প্রচারটি তিনি মৌখিকভাবেই করেছিলেন, অদ্ভুত সংগঠিত প্রচার। অন্তত কয়েকজন লোকও তাঁর এই প্রচারের সহায়ক না হ’লে কলকাতাময় তিনি একা মৌখিক এই কথাটা ছড়িয়ে দিতে পারতেন না।

তিন.
আমরা ইতিহাস পাঠ থেকে জানতে পারি, নজরুলের মুখে বিদ্রোহী কবিতা শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে আলিঙ্গন করে সম্মান জানিয়েছিলেন। অনেক স্বনামখ্যাত কবি সাহিত্যিকরা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার লেখার জন্যে ধন্য ধন্য করেছিলেন। কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিভার তখন মধ্যাহ্ন দীপ্তি। দেশের যুবজনের মনে তাঁর আসন পাকা। তারই মাঝে হঠাৎ আর একটা তীব্র প্রবল তুফানের ঝাপটা কাব্যের রূপ নিয়ে তরুণ মনকে উদ্বেল করে তুলেছিল- ‘আমি ঝঞ্জা আমি ঘূর্ণি/আমি পথ সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। “কাব্য-বিচারে ‘বিদ্রোহী’র মূল্য সকলের কাছে সমান না হতে, পারে কিন্তু তদানীন্তন যুগ-মানস যে এই কবিতার মধ্যেই প্রতিবিম্বিত এ-কথা কেউ বোধহয় অস্বীকার করবেন না। ”

সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, বিদ্রোহী পড়লুম ছাপা অক্ষরে মাসিক পত্রে-মনে হলো এমন কখনও পড়িনি। অসহযোগ অগ্নিদীক্ষার পরে সমস্ত মন প্রাণ যা কামনা করেছিল এ যেন তা-ই। দেশব্যাপী উদ্দীপনার এই যেন বাণী। । ড. বিজয় কুমার সরকার মন্তব্য করেছিলেন, “বিদ্রোহী দেখামাত্র নজরুলের ভিতর আমি হুইটম্যান এবং রবীন্দ্রনাথ দু’জনকে একসঙ্গেই পাকড়াও করেছিলাম। তবুও বুঝেনিলাম লেখক বাপ্ কা বেটা বটে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম কুরুক্ষেত্রের পরবর্তী অন্যতম যুগ প্রবর্তক বাঙালীর বাচ্চা নজরুল”।

‘বিদ্রোহী কবিতা সম্পর্কে পরিমল গোস্বামী বলেছেন: “অত্যাচারীর বিরুদ্ধে এমন ভাষায় আর কোন বাঙালি কবি চ্যালেঞ্জ জানাননি। সমাজের উৎপীড়ন এমন শপথ আর কারও মুখে তো শুনিনি। Must fight to the finish মন্ত্রে দীক্ষিত আর কোনো বাঙালি কবি শত্রুপক্ষকে এমন আহ্বান জানাননি। ” অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৪-১৯৭৬) বলেছেন: “এ কবিতায় হিন্দু মুসলমান দু’জনেরই এত পুরাণ প্রসঙ্গ ঢুকেছে যে ব্রিটিশ সরকার সরাসরি একে রাজদ্রোহ বলে চিহ্নিত করতে পারলো না। কখনো ঈশান বিষানের ওঙ্কার বাজছে, কখনো বা ইস্রাফিলের শিঙ্গা থেকে উঠলে রণহুঙ্কার। কখনো বা হাতে নিয়েছে মহাদেবের ডমরু-ত্রিশূল, কখনো বা অর্ফিয়াসের বাঁশি। কখনো বাসুকীর ফনা জাপটে ধরেছে। কখনো বা জিব্রাইলের আগুনের পাখা, কখনো চড়েছে “তাজি বোররা’কে (পক্ষীরাজ ঘোড়া) কখনো বা উচ্চেঃশ্রবায়।

একে রাজদ্রোহ বলতে গেলে ধর্মের উপরে হাত দেওয়া হবে। ” শুধু বিতর্ক-অভিনন্দনই নয়, বিদ্রোহী কবিতা তখন বাংলার যুবমানসকে অনুপ্রাণিত করেছিল, বিপ্লবীদের কণ্ঠে দিয়েছিল বৈপ্লবিক ভাষা, সমাজের বিভিন্ন স্তরে জাগ্রত করেছিল চেতনা। কবিতাটিতে কবির আত্মজাগরণ বিভিন্ন রূপে, বিচিত্র ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিতে বিদ্রাহীভাবের প্রকাশ পরিলক্ষিত হলেও কবিতাটি প্রধানত আত্মজাগরণমূলক। কবিতার শুরুতেই কবি মানুষের মধ্যকার অপরিমেয় শক্তি বীর ব্যাঞ্জনায় আখ্যায়িত করে মানুষের অন্তস্থিত সুপ্ত চেতনাকে জাগাতে চেয়েছেন।

কাজী আবদুল ওদুদের ‘নজরুল ইসলাম’ প্রবন্ধে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ভাব সম্পর্কে মন্তব্যটি নিম্নরূপ: “বিদ্রোহী কবিতায় কবি কি বলতে চেয়েছেন এ সম্বন্ধে নানা মত শুনতে পাওয়া যায়। কবির প্রায় ২৩ বৎসরের বিপুল সাহিত্য সাধনার উপরে চোখ বুলিয়ে আমার মনে হয়েছে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকৃতই কোন বিদ্রোহ-বাণীর বাহক নয়, এর মর্মকথা হচ্ছে এক অপূর্ব উন্মদনা- এক অভূতপূর্ব আত্মবোধ-সেই আত্মবোধের প্রচণ্ডতায় ও ব্যাপকতায় কবি উচ্চকিত-প্রায় দিশাহারা। এর মনে যে ভাব সেটি এক সুপ্রাচীন তত্ত্ব, ভারতীয় ‘সোহম’; ‘শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’, ‘যত্র জীব তত্র শিব’ প্রভৃতি বাণীতে তা ব্যক্ত হয়েছে, সুফীর ‘আনাল হক’ বাণীতেও সে-তত্ত্ব রয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগরূপ মহাবিদ্রোহও হয়তো এর মূলে রস জুগিয়েছিল। ”

সংবর্ধনা সভায় নজরুল বলেছিলেন, আমার বিদ্রোহী পড়ে যাঁরা আমার ওপর বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন, তাঁরা যে হাফেজ-রুমিকে শ্রদ্ধা করেন, এও আমার মনে হয় না। আমি তো আমার চেয়েও বিদ্রোহী মনে করি তাঁদের। এঁরা কী মনে করেন, হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিলেই সে কাফের হয়ে যাবে?…বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির দুহিতা না হলেও পালিতা কন্যা। কাজেই হিন্দুর ভাবধারা এতে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, ও বাদ দিলে বাংলা সাহিত্যের অর্ধেক ফোর্স নষ্ট হয়ে যাবে।

ইংরেজি সাহিত্য থেকে গ্রিক পুরাণের ভাব বাদ দেওয়ার কথা কেউ ভাবতেই পারে না। বাংলা সাহিত্য হিন্দু মুসলমানের উভয়ের সাহিত্য। এতে হিন্দুদেব-দেবীর নাম দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায়, হিন্দুরও তেমন মুসলমানের দৈনন্দিন জীবন যাপনের মধ্যে নিত্য প্রচলিত মুসলমানি শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্যে দেখে ভ্রু কোঁচকানো অন্যায়। আমি হিন্দু মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের এ সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করি বা হিন্দু দেব দেবীর নাম নিই।

শুধু বিতর্ক-অভিনন্দনই নয়, বিদ্রোহী কবিতা তখন বাংলার যুবমানসকে অনুপ্রাণিত করেছিল, বিপ্লবীদের কণ্ঠে দিয়েছিল বৈপ্লবিক ভাষা, সমাজের বিভিন্ন স্তরে জাগ্রত করেছিল চেতনা। কবিতাটিতে কবির আত্মজাগরণ বিভিন্নরূপে, বিচিত্রভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছিল। তাই এক কথায় বলা যায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা অনন্তকাল ধরে আমাদের প্রেরণা জোগাবে।

আরো পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পড়ুন এই বিভাগের আরও খবর

Chairman Md. Azadul Islam. CEO Md. Amir Hossain. Editor S, M, Shamim Ahmed. Managing Director Md. Lokman Mridha, office House # 43 ( Ground Flooor ) 47 Road No. 30, Mirpur, Dhaka Division - 1216

 

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: রায়তা-হোস্ট
tmnews71